সংবাদ শিরোনাম:

সুন্দরবনের আগুন নেভানোয় সমাধান কোনপথে?

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

নিজস্ব প্রতিবেদকধ

সুন্দরবন বাংলাদেশের ঢাল। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে বুক চিতিয়ে ঠেকানো সাহস। দুর্যোগ যে ক্ষত তৈরি করে তা সারিয়ে তুলে রুখে দাঁড়ায় বারবার। প্রাণবৈচিত্র্যে ভরপুর এই বন দেশের অমূল্য সম্পদ। জীবন-জীবিকার অন্যতম আধার। প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষত থেকে দ্রুত সেরে উঠলেও মনুষ্যসৃষ্ট ক্ষত এখন সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় হুমকি।
বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন ধ্বংস মানে নিজেদের ধ্বংসের মুখে ফেলা। গত দুই দশকে ২৪ বার আগুনে পুড়েছে সুন্দরবন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ব্যাপকভাবে। সবগুলোই ঘটেছে পূর্ব সুন্দরবন এলাকায়। এসব অগ্নিকাণ্ডে গঠিত তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে ঘুরেফিরে আসে একই সুপারিশ। এতে স্পষ্ট হয়, আগের সুপারিশ কার্যকর হয় না। আগুনের কারণ হিসেবে প্রতিবারই উঠে আসে জেলে, মৌয়ালদের বিড়ি-সিগারেট বা মৌমাছি তাড়াতে জ্বালানো মশাল।
সবশেষ গত ৪ মে সুন্দরবনের আমোরবুনিয়া এলাকায় আগুন লাগে। এরপর বন বিভাগ, ফায়ার সার্ভিস, পুলিশ ও উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করা হয়। পরে ফায়ার সার্ভিস, নৌবাহিনী, বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার, কোস্টগার্ড ও বন বিভাগের নিজস্ব ফায়ার ইউনিট আগুন নেভানোর কাজ শুরু করে। ৬ মে সকাল থেকে সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আরও জোরেশোরে আগুন নেভানোর কাজ শুরু হয়। ওইদিন দুপুর নাগাদ আগুন সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে বলে জানায় ফায়ার সার্ভিস।
ফায়ার সার্ভিস বলছে, সুন্দরবনের আগুনটি ছিল বুশ ফায়ার বা দাবানল। অগ্নিকাণ্ডের ব্যাপ্তি ছিল প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার। জীবজন্তু ও ঘন বনের কারণে সেখানে আগুন নিয়ন্ত্রণ করতে গেলে স্বাভাবিকভাবে শ্বাস-প্রশ্বাস গ্রহণ করা কঠিন। অগ্নিনির্বাপণে দূরবর্তী নদী ছাড়া পানির কোনো উৎস ছিল না সেখানে। পানির উৎস থেকে আগুনের দূরত্ব ছিল প্রায় আড়াই কিলোমিটার। চলাচলের রাস্তা ছিল পায়ে হাঁটা ও দুর্গম।
সুন্দরবন পূর্ব বন বিভাগের নথি থেকে জানা যায়, ২০০২ সালে সুন্দরবনের পূর্ব বিভাগের চাঁদপাই রেঞ্জের কটকায় একবার, একই রেঞ্জের নাংলী ও মান্দারবাড়িয়ায় দুবার, ২০০৫ সালে পচাকোড়ালিয়া, ঘুটাবাড়িয়ার সুতার খাল এলাকায় দুবার, ২০০৬ সালে তেড়াবেকা, আমুরবুনিয়া, খুরাবাড়িয়া, পচাকোড়ালিয়া ও ধানসাগর এলাকায় পাঁচবার, ২০০৭ সালে পচাকোড়ালিয়া, নাংলী ও ডুমুরিয়ায় তিনবার, ২০১০ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১১ সালে নাংলীতে দুবার, ২০১৪ সালে গুলিশাখালীতে একবার, ২০১৬ সালে নাংলী, পচাকোড়ালিয়া ও তুলাতলায় তিনবার এবং ২০১৭ সালে মাদ্রাসারছিলায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটে।
সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, অগ্নিকাণ্ডে প্রাণীবৈচিত্র্য ও পরিবেশের ক্ষতি ধরা হয় আনুমানিক হিসাবে। ফলে এসব আগুনে ক্ষয়ক্ষতির প্রকৃত চিত্র আসেনি।
দুর্ঘটনার প্রতিবেদনগুলো বিশ্লেষণে দেখা যায়, অধিকাংশ আগুনের সূত্রপাত জেলে-মৌয়ালদের অসাবধানতায়। অর্থাৎ জেলে-মৌয়ালদের বিড়ি-সিগারেট বা মৌমাছি তাড়াতে জ্বালানো মশাল থেকেই সবচেয়ে বেশি আগুন লেগেছে।
দুই দশকে ২৪ বার অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ‘অ্যালার্মিং’ বলে দাবি বিশেষজ্ঞ ও বনসংশ্লিষ্টদের। তারা বলছেন, এভাবে সুন্দরবনে বারবার আগুন লাগা হুমকিস্বরূপ। সবশেষ আগুনে ৭ দশমিক ৯৮ একর বনভূমি আক্রান্ত ও সাড়ে ৫ একর বনভূমি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
প্রশ্ন হলো অন্য দেশের মতো বাংলাদেশেও যদি দাবানলের মতো আগুন লাগে সেক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ সেক্ষমতা কতটা? এই প্রশ্নের উত্তর খুঁজতে গিয়ে বেরিয়ে এসেছে দাবানলের মতো আগুন লাগলে বাংলাদেশের সক্ষমতা নেই সে আগুন সহজে নিয়ন্ত্রণ করার।
দাবানল হচ্ছে বনভূমি বা গ্রামীণ এলাকার বনাঞ্চলে সংঘটিত একটি অনিয়ন্ত্রিত আগুন। উত্তপ্ত আবহাওয়ায় বনাঞ্চলসমৃদ্ধ যে কোনো স্থানেই দাবানল দেখা দিতে পারে। সাধারণত, যখন কোনো আগুনের উৎস প্রচণ্ড তাপমাত্রা এবং যথেষ্ট পরিমাণে অক্সিজেনের উপস্থিতিতে দাহ্য পদার্থের সংস্পর্শে আসে, তখন দাবানলের সূত্রপাত। পাহাড়ি অঞ্চলে দাবানল হয় কিছু বেশি।
গত বছরের ৮ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্রের হাওয়াইয়ের মাউই দ্বীপে ভয়াবহ দাবানলে মাউইয়ের ঐতিহাসিক শহর লাহাইনার এক বড় অংশই পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে যায়। সেই দাবানলে মারা যান শতাধিক মানুষ।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের দাবানলের আগুন নিয়ন্ত্রণে রয়েছে ‘বিশেষজ্ঞ ফায়ার ফাইটার টিম’ এবং বিশেষ ‘ফায়ার ফাইটার হেলিকপ্টার’। যে হেলিকপ্টার দিয়ে খুব কাছ থেকে আগুন নিয়ন্ত্রণে পানি ঢাললেও বাতাস লাগে না। এতে আগুন ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কাও থাকে না।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বলছে, বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতো বাংলাদেশের ফায়ার সার্ভিসেরও আধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে আগুন নিয়ন্ত্রণের জন্য। তবে দাবানলের মতো আগুন নিয়ন্ত্রণে অভিজ্ঞতা কিংবা সরঞ্জাম নেই। অন্য দেশে ফায়ার ফাইটিং হেলিকপ্টার থাকে, যা আমাদের নেই। এছাড়া বন-জঙ্গলে আগুন নিয়ন্ত্রণে স্পেশাল টিম থাকে ফায়ার সার্ভিসের, সেটিও নেই বাংলাদেশে।
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক পরিচালক (অপারেশন অ্যান্ড মেনটেন্যান্স) মেজর (অব.) এ কে এম শাকিল নেওয়াজ বলেন, ‘সুন্দরবনের আগুন নিয়ন্ত্রণে ফায়ারের দক্ষতা বাড়াতে হবে। উন্নত দেশগুলোতে এমন আগুন লাগলে ট্রেইন করে। সুন্দরবনের ক্ষেত্রেও ট্রেইন করতে হবে। তাহলে আগুন ছড়াতে পারবে না। বুশ ফায়ার ফাইটিং দক্ষতা বাড়ানো প্রয়োজন। সেখানে যারা আগুন নেভাবে তাদের জঙ্গলে আগুন নেভানোর জন্য অভিজ্ঞ হতে হবে। তাদের স্টেশন জঙ্গলেই হবে।’
খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফরেস্ট্রি অ্যান্ড উড টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. ওয়াসিউল ইসলাম বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়া, ইউরোপ-আমেরিকার মতো উন্নত নই আমরা। স্পেশাল হেলিকপ্টারের জন্য অর্থ এবং প্রশিক্ষণ প্রয়োজন। তবে ফায়ার ফাইটিং হেলিকপ্টার থাকলে আগুন দ্রুত নিয়ন্ত্রণ করা যেত।’
সুন্দরবনে ২৪ বার আগুন কেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, সচেতনতা ছাড়া এমন আগুন বারবার লাগতে পারে। অনিচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগতে পারে আবার ইচ্ছাকৃতভাবে আগুন লাগতে পারে।
বাওয়ালি বা মৌয়াল যারা রয়েছেন তাদের আগুন ব্যবহারের পর সচেতন থাকা দরকার। সব ক্ষেত্রে সাবধানতা অবলম্বন করা প্রয়োজন। বিশেষ করে শুষ্ক মৌসুমে বন বিভাগ মৌয়াল-বাওয়ালদের মৌখিক ও লিখিতভাবে আগুনের ক্ষেত্রে সচেতন করতে পারে। জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থাও নিতে হবে।
খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (পশ্চিম বন বিভাগ) ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেন বলেন, ‘জোয়ার-ভাটার জন্য খাল খনন করতে হবে। কিন্তু পানি উন্নয়ন বোর্ড যে ভুলটি করে তা হলো- খাল খনন করে মাটিগুলো দুই পাশে দিয়ে দেয়। মাটি দুই পাশে দেওয়া যাবে না, অন্য জায়গায় মাটি ফেলতে হবে।’
‘সুন্দরবনে উত্তর-দক্ষিণের খাল খনন করতে হবে। পূর্ব-পশ্চিমের খাল কেটে কোনো লাভ হবে না। কারণ সুন্দরবনের সব নদীর ফ্লো উত্তর-দক্ষিণে। জোয়ারের পানি উত্তর-দক্ষিণ দিক থেকেই ওঠে। সবগুলো খালের মুখ খুলে দিতে হবে। এপ্রিল ও মে সবচেয়ে সেনসিটিভ মাস। বিশেষ করে এই দুই মাসে পাঁচটি অঞ্চলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে প্রতি সপ্তাহে।’
খুলনা বিভাগীয় বন কর্মকর্তা (পূর্ব বন বিভাগ) কাজী মুহাম্মদ নূরুল করিম জাগো নিউজকে বলেন, ‘আসলে হেলিকপ্টার দিয়ে আগুন নেভানোয় খুব বেশি লাভ হয় না। সুন্দরবনের আগুন সাধারণত মাটিতে থাকে। কারণ লতা-পাতা নিচে পড়ে প্রায় ৭-৮ ইঞ্চি উঁচু হয়ে যায়। এজন্য পানি দেওয়ার ক্ষেত্রে সরাসরি মাটিতে পানি দিলে আগুন খুব দ্রুত নিয়ন্ত্রণ সম্ভব।’
ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের মিডিয়া সেলের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা সিনিয়র স্টাফ অফিসার মো. শাহজাহান শিকদার জাগো নিউজকে বলেন, ‘অস্ট্রেলিয়ার বুশ ফায়ার (দাবানল) ৩০-৩৫ দিন ধরে নেভাতে হয়েছে। অস্ট্রেলিয়া উন্নত একটা দেশ। তাদের আধুনিক প্রযুক্তি রয়েছে। সেই দেশে দাবানল নিয়ন্ত্রণে যদি এতদিন সময় লাগে বাংলাদেশেও অনেক সময় লাগবে। কারণ আগুন নেভানোর কাজটাই কষ্টসাধ্য।’
‘উন্নত দেশগুলোতে আগুন নেভানোর জন্য যেসব সরঞ্জাম রয়েছে বাংলাদেশেও সেসব আধুনিক সরঞ্জাম রয়েছে। নেই শুধু বুশ ফায়ার ফাইটার হেলিকপ্টার এবং সুন্দরবনের মতো জায়গায় আগুন লাগলে সরঞ্জাম নিয়ে যাওয়ার মতো কোনো রাস্তা।’
সাধারণ হেলিকপ্টার ফায়ার ফাইটিং হেলিকপ্টার নয় উল্লেখ করে ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা বলেন, ‘সাধারণ যে হেলিকপ্টার রয়েছে তার বাতাস নিচের দিকে আসে। ফায়ার ফাইটিং হেলিকপ্টারের নিচের দিকে সরাসরি না গিয়ে হরাইজন্টালি দুই পাশে যায়। যাতে বাতাস লেগে আগুন আরও ছড়িয়ে না পড়ে।’
‘খেলার মাঠ কিংবা গ্রামাঞ্চলে যখন হেলিকপ্টার নামে তখন প্রচুর ময়লা উড়তে থাকে। অক্সিজেনের সরবরাহ পেলে আগুন আরও বেড়ে যাওয়ার ঝুঁকি তৈরি হয়। তাই বিমান বাহিনীর হেলিকপ্টার কমপক্ষে ৪০ ফুট ওপর থেকে হেলিকপ্টারের মাধ্যমে পানি ছোড়ে। ফায়ার ফাইটিং হেলিকপ্টার হলে আরও নিচ থেকে পানি ছিটানো যাবে। বুশ ফায়ারের ক্ষেত্রে হেলিকপ্টারই মূল।’
ফায়ার সার্ভিসের সাবেক মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আলী আহাম্মেদ খান জাগো নিউজকে বলেন, ‘মডার্ন ফায়ার ব্রিগেডের জন্য ফায়ার ফাইটিং হেলিকপ্টার অবশ্যই প্রয়োজন। বনাঞ্চলের আগুন নেভাতে হেলিকপ্টার ছাড়া সম্ভব নয়। এছাড়া সুন্দরবনের আগুন নেভানোর জন্য বিশেষায়িত ফায়ার ফাইটিং টিম গঠন করা যেতে পারে। স্পেশাল ফায়ার ফাইটিংয়ের জন্য একাডেমিও নেই আমাদের, যা জরুরি।’
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সুরক্ষা সেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব (অগ্নি অনুবিভাগ) মো. জিয়াউল হক জাগো নিউজকে বলেন, ‘ফায়ার ফাইটিং হেলিকপ্টার বিষয়ে ফায়ার সার্ভিস থেকে প্রস্তাব পেলে দেখা হবে।’

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *