নিজস্ব প্রতিনিধি:
রাস্তায় পড়ে থাকা অসহায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের ‘আশ্রয় দিতে’ আশ্রয়কেন্দ্র খুলেছিলেন মিল্টন সমাদ্দার। প্রায় এক দশক ধরে ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার’ নামের আশ্রয়কেন্দ্রটিতে অসহায় নারী, শিশু ও বৃদ্ধদের আশ্রয়, চিকিৎসা সেবা ও মৃত্যুর পর দাফন-কাফনের ব্যবস্থা করে আসছিলেন তিনি। সম্প্রতি এই মানবসেবার আড়ালে প্রতারণার মাধ্যমে মৃত্যুর জাল সনদ তৈরিসহ নানান অনিয়মের অভিযোগ ওঠে তার বিরুদ্ধে। বিভিন্ন গণমাধ্যমে নেতিবাচক সংবাদ প্রকাশের পর গত ১ মে রাতে তাকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি)। এরপর থেকেই নানামুখী সংকটে পড়েছে আশ্রয়কেন্দ্রটি। আশ্রিতদের প্রতিদিনের খাবার জোগান দিতেই হিমশিম খাচ্ছেন আশ্রয়কেন্দ্রের কর্মচারীরা। প্রশ্ন উঠেছে, প্রায় একেবারে অচল নারী, শিশু ও বৃদ্ধ মানুষগুলোর কী হবে?
শুক্রবার (৩ মে) সরেজমিনে মিরপুরের দারুস সালাম এলাকার কল্যাণপুর নতুন বাজার রোডে অবস্থিত আলোচিত ‘চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারে’ গিয়ে দেখা যায় এমন চিত্র। সেন্টারে চিকিৎসার সরঞ্জাম ও খাদ্য সংকটের মুখে পড়েছেন আশ্রয় কেন্দ্রের শিশু, মহিলা ও বৃদ্ধসহ সেবা গ্রহীতারা। কর্মীদের মধ্যেও দেখা দিয়েছে নানান অনিশ্চয়তা। এমন অবস্থায় আশ্রয়কেন্দ্রে থাকা এই অসহায় মানুষগুলোর কী হবে, কীভাবে চলবে তাদের সেবা, কে চালাবে এই আশ্রম! এ নিয়ে নানা সংশয় দেখা দিয়েছে সমাজকর্মী ও শুভাকাঙ্ক্ষীদের মাঝে।
আশ্রয়কেন্দ্রটিতে গিয়ে জানা যায়, যেখানে কয়েকদিন আগেও তিন বেলা খাবার খেতে পারতো এখানকার অসহায় মানুষগুলো। আজ তারা দু’বেলাও ঠিকমতো খেতে পারছেন না। আশ্রমে খাবার সঙ্গে ফুরিয়ে গেছে চিকিৎসা সরঞ্জাম ও ওষুধপত্র। শিশু, নারী ও বৃদ্ধ মিলে প্রায় ২৮ জন অসহায় মানুষ রয়েছে মিল্টনের এই আশ্রমে। এছাড়াও বাবুর্চি, সেবক-সেবিকা ও নিরাপত্তা রক্ষীসহ আছেন ২৫ জন কর্মী। ঝামেলা এড়াতে এরই মধ্যে কয়েকজন কর্মী আশ্রয়কেন্দ্র ছেড়ে চলেও গেছেন বলে জানা গেছে।
আশ্রয়কেন্দ্রটিতে বাবুর্চি হিসেবে কাজ করেন জসিম উদ্দিন। তিনি বলেন, ‘দুদিন ধরে আশ্রমে খাবার নেই। দোকান থেকে সামান্য দিছু চাল-ডাল, আলু-পেঁয়াজ বাকিতে এনে রান্না করেছি। শিশুদের দুগ্ধ জাতীয় খাবারও নেই। এখানের অসহায় মানুষগুলোর সকালের খাবার, রাতে কী খাবেন, তা জানি না। মিল্টন জেলে যাওয়ার পর এখনও কেউ কোনও খোঁজখবর নিচ্ছেন না। কয়েকজন কর্মীও চাকরি ছেড়ে চলে গেছেন।’
চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ারের এক শুভাকাঙ্ক্ষী সমাজকর্মী আকাশ আহমেদ বলেন, মিল্টনের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ উঠেছে সেগুলো কতটা সত্য, তা তদন্তের পর জানা যাবে। তবে এই আশ্রয়কেন্দ্র থেকে অনেক অসহায় মানুষ সেবা পেয়েছে। যে মানুষগুলোকে পুলিশ, সমাজসেবা অধিদফতর বা কোনও সংস্থা সেবা দেয়নি। শরীরের বিভিন্ন অংশ পচে রাস্তায় পড়ে থাকা সেই মানুষগুলোকে এই আশ্রমে চিকিৎসা দেওয়া হয়েছে।
এই সমাজকর্মীর ভাষ্য, ‘এখনও এই চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার সেন্টারে অনেক অসহায় সেবা গ্রহীতা আশ্রয় নিচ্ছেন। শুনেছি কর্মীরা চলে যাচ্ছেন। খাদ্য সংকট দেখা দিয়েছে। তাহলে এই অসহায় মানুষদের কী হবে। তাদের দেখবে কে!’ মিল্টনের মামলার তদন্তকারী সংস্থা কিংবা সরকারের পক্ষ থেকে এই আশ্রয়কেন্দ্রটি পরিচালনারও দাবি জানান তিনি।
গত বুধবার (১ মে) রাতে রাজধানীর মিরপুর এলাকায় অভিযান চালিয়ে মিল্টন সমাদ্দারকে গ্রেফতার করে ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা (ডিবি) পুলিশ। তার বিরুদ্ধে মিরপুর মডেল থানায় মানবপাচার, জাল মৃত্যুসনদ ও আটকে রেখে মারধরের অভিযোগে তিনটি মামলা করা হয়েছে। এসব মামলায় বৃহস্পতিবার (২ মে) তাকে তিন দিনের জিজ্ঞাসাবাদের জন্য পেয়েছে ডিবি পুলিশ।
আশ্রয়কেন্দ্র পরিচালনার ব্যাপারে জানতে গোয়েন্দা পুলিশের সঙ্গে যোগাযোগ করে কারও বক্তব্য পাওয়া যায়নি। তবে মিরপুর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মুন্সী সাব্বির আহমেদ বলেন, চাইল্ড অ্যান্ড ওল্ড এজ কেয়ার কীভাবে চলবে বা এখন কারা চালাবে, জানি না। এ ব্যাপারে আশ্রয়কেন্দ্র থেকে আমাদের কাছে কেউ আসেনি। এই ব্যাপারে আমরা কিছু জানি না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহযোগী অধ্যাপক এবং সমাজ ও অপরাধ বিশেষজ্ঞ ড. তৌহিদুল হক বলেন, সামাজিক ও মানবিক কার্যক্রমের আড়ালে যারা অপরাধ কর্মকাণ্ড করে। তাদের অবশ্যই আইনের আওতায় আনতে হবে। মিল্টন সমাদ্দারের বিরুদ্ধেও অনেক ভয়ংকর অভিযোগ আসছে। তদন্তে তার প্রকৃত অপরাধ চিত্র বেরিয়ে আসবে। তবে তার আশ্রয়কেন্দ্র বা আশ্রয়কেন্দ্রের অসহায় মানুষগুলোর সেবায় কারও কারও দায়িত্ব নিতে হবে। সামাজিক প্রতিষ্ঠান পরিচালনা সরকারের নীতিমালা আছে, সমাজ সেবা অধিদফতর আছে।
সমাজসেবা অধিদফতরের অতিরিক্ত পরিচালক (প্রতিষ্ঠান) মো. শহীদুল ইসলাম বলেন, ‘আমরা সরকারি প্রতিষ্ঠান ও এতিমখানাগুলোতে দেখভাল করে থাকি। বেসরকারি সামাজিক প্রতিষ্ঠানগুলো তারাই দেখে থাকে। তাছাড়া যদি সমাজসেবা অধিদফতরের রেজিস্ট্রেশনভুক্ত সংস্থার কোনও সমস্যা হয়ে থাকে, তাহলে আমরা পরিচালনায় সহায়তা করার জন্য প্রশাসক নিয়োগ দিতে পারি।’