নিজস্ব প্রতিনিধি:
দিনাজপুরের হিলিতে ইতিমধ্যেই শুরু হয়েছে চলতি বোরো মৌসুমের ধান কাটা ও মাড়াই। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় গতবছরের চেয়ে এবার ধানের ভালো ফলন পাওয়ায় খুশি কৃষকরা। তবে উৎপাদন খরচের তুলনায় দাম কম হওয়ায় খরচ তোলা নিয়ে সংশয়ে পড়েছেন চাষি। প্রথমের দিকে ধানের দাম কিছুটা বেশি থাকলেও দিন দিন কমছে। তাই ধানের দাম বাড়ানোর দাবি কৃষকদের। তবে স্থানীয় কৃষি বিভাগের দাবি, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ধানের ভালো ফলনের পাশাপাশি দাম ভালো থাকায় লাভবান হওয়ায় কৃষকরা খুব খুশি।
শষ্যভান্ডার খ্যাত দিনাজপুরের হিলিতে ইতিমধ্যেই বেশিরভাগ জমির ধান পেকে যাওয়ায় কর্তন শুরু করেছেন কৃষকরা। এবারে আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় ও রোগবালাই ও পোকামাকড় তেমন আক্রমণ না করায় গতবারের চেয়ে ধানের ভালো ফলন হয়েছে। বিঘা প্রতি ধানের ফলন ২১ থেকে ২৫ মণ করে হয়েছে। তবে তাপপ্রবাহ ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে কিছু জমিতে উৎপাদন কম হয়েছে। এ ছাড়া সার, কীটনাশক ও সেচের পানির দাম বৃদ্ধির কারণে খরচ হয়েছে বেশি। কিন্তু ধানের দাম গতবারের চেয়ে কম হওয়ায় উৎপাদন খরচ উঠবে না বলে জানিয়েছেন কৃষক।
হিলির গোহাড়া গ্রামের কৃষক বাদল উড়াও বলেন, বর্তমানে ধানের যে দাম চলছে তাতে করে ধান আবাদ করে লোকসান। তারপরও বৃষ্টির আগে ধানের যে দাম ছিল সেই দামটা থাকলে হয়তোবা কিছু লাভের মুখ দেখতে পারতাম। কিন্তু বৃষ্টির পর আবহাওয়ার কারণে দাম অনেকটা কমে গেছে। বৃষ্টির আগে দাম ১২৫০ টাকা মণ থেকে শুরু করে ১৩০০ টাকা পর্যন্ত উঠেছিল। কিন্তু যেই বৃষ্টি হলো সেই দাম কমে ১০৫০ টাকা থেকে শুরু করে ১১০০ চলছে। একেতো শ্রমিকের মজুরি বাবদ খরচ বেড়েছে। এর ওপর তীব্র গরম ও বিদ্যুৎ বিভ্রাটের কারণে জমিতে ঠিকমতো পানি দিতে না পারায় ফলন কম হচ্ছে।
হিলির ছাতনি গ্রামের কৃষক জহুরুল ইসলাম বলেন, ধানের ফলন বেশ ভালোই হয়েছে- এতে আমরা খুশি। কিন্তু ধান লাগানো থেকে শুরু করে মাড়াই পর্যন্ত যে খরচ হয়েছে সেই তুলনায় দামটা গতবারের চেয়ে একটু কম। এক বিঘা জমি চাষে খরচ হয়েছে ১২০০, ধান লাগাতে ১২০০, জমিতে দিতে পানি সেচ বাবদ ১৪০০, সার ও কীটনাশক প্রয়োগ করতে লাগছে ৫ থেকে ৬ হাজার, ধান কর্তন বাবদ ৪ থেকে ৫ হাজার টাকা। সবমিলিয়ে এক বিঘা জমিতে ধান লাগানো থেকে শুরু করে ধান কর্তন পর্যন্ত ১৪ থেকে ১৫ হাজার টাকার মতো খরচ হয়ে যাচ্ছে। এটা যাদের নিজস্ব জমি তাদের হিসেব। যারা বর্গা নিয়েছে তাদের খরচ আরও বেশি। সেই তুলনায় ধানের দামটা যদি একটু ভালো থাকতো এমনকি গতবারের মতো থাকতো তাহলে কৃষকরা বেশ লাভবান হতে পারতো।
হিলির রাঙামাটিয়া গ্রামের কৃষক সোহেল রানা বলেন, আলহামদুলিল্লাহ এবারে ধানের অবস্থা খুব ভালো। গতবারের চেয়ে ফলন বেশি হয়েছে। বর্তমানে আবহাওয়া বেশ ভালো রয়েছে- যার কারণে আমরা নির্বিঘ্নে ধান কেটে ঘরে তুলতে পারছি। তবে ধানের দামটা গতবারের তুলনায় কম। মন প্রতি দুই থেকে আড়াইশো টাকার মতো এবারে ধানের দাম কম। সেই হিসেবে ফলন গতবারের চেয়ে একটু ভালো হওয়ায় লাভ হবে। কিন্তু দামটা যদি আরেকটু বেশি হতো কৃষকদের লাভের অঙ্ক বেশি হতো।
একই গ্রামের কৃষক মমতাজ হোসেন বলেন, মাঝে যে তীব্র খরা দেখা দিয়েছিল তাতে কৃষকরা তো বোরো ধান আবাদ করে ফলন পাওয়া নিয়ে হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছিলাম। দীর্ঘদিন ধরে বৃষ্টি নেই, বিদ্যুতের অভাবে সেচ ঠিকমতো দেওয়া যায়নি। যার কারণে ফলন কেমন হবে না হবে সেই নিয়ে দুশ্চিন্তায় ছিলাম। তারপরও ভালো ফলন হয়েছে। গতবারের চেয়ে এবারে ধানের ফলন অনেকটাই বেড়েছে। বিঘা প্রতি (৩৩ শতক) ধানের ফলন হয়েছে ২২ মণ থেকে ২৬ মণ পর্যন্ত। বর্তমানে আবহাওয়া ভালো রয়েছে, যার কারণে ধান কাটা ও মাড়াই সুন্দরভাবে করতে পারছি। ধানের দাম এবারে কিছুটা কম। কখনও ১০৫০ আবার কখনও ১১০০ টাকা চলছে।
ধান কাটা শ্রমিক বাদল মার্ডি বলেন, গতবার ৪০০০ শুরু করে ৪৫০০ টাকায় বিঘা হিসাবে জমির ধান কর্তন করেছিলাম। কিন্তু বর্তমানে ৪০০ টাকা বিঘা চুক্তিতে ধান কর্তনের কাজ করছি। কিন্তু এই টাকা দিয়ে আমাদের পোষাচ্ছে না। যে হারে চাল ডাল তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের দাম বাড়ছে সেই তুলনায় এই টাকা দিয়ে আমাদের শ্রমিকদের তো কিছুই হচ্ছে না। তাই টাকার পরিমাণটা যদি আরেকটু বাড়ানো হতো তাহলে আমাদের মতো শ্রমিকদের জন্য একটু ভালো হতো।
হাকিমপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা আরজেনা বেগম বলেন, চলতি বোরো মৌসুমে হাকিমপুর উপজেলায় সাত হাজার ৬১৫ হেক্টর জমিতে আবাদের লক্ষ্যমাত্রা থাকলেও আমরা সাত হাজার ৬১৬ হেক্টর জমিতে বোরো ধান রোপণ করতে সক্ষম হয়েছিলাম। ইতিমধ্যেই জমির ধান কর্তন শুরু হয়েছে, আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় গতবছরের তুলনায় এবারে ধানের ভালো ফলন হয়েছে। ২ থেকে ৩ গুণের মতো ফলন বেড়েছে। এতে কৃষকরাও বেশ খুশি। সেই সঙ্গে বর্তমানে ধানের যে দাম চলছে তাতে কৃষকরাও বেশ সন্তুষ্ট। সেই সঙ্গে কৃষি বিভাগ থেকে পরামর্শ দেওয়া হচ্ছে জমির ৮০ ভাগ ধান পেকে গেলেই দ্রুত সেই জমির ধান কর্তন করতে।
তিনি আরও বলেন, এ ছাড়া কম্বাইন্ড হারভেস্টার মেশিনগুলো দিয়ে দিনে ও রাতে ধান কর্তন চলছে। আমরা আশা করছি, আগামী এক সপ্তাহের মধ্যে ৭০ থেকে ৭৫ শতাংশ ধান কর্তন সম্পন্ন হবে। যেহেতু ভালো ফলন ও দাম ভালো থাকায় কৃষকরা লাভবান হবেন এটা আমরা আশা করছি।