সংবাদ শিরোনাম:

বিবি-বাইডেনের সখ্যতায় ফাটল কি লোক দেখানো?

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

আন্তর্জাতিক ডেস্ক:

ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন বিবি নেতানিয়াহুকে দক্ষিণ গাজার রাফাহ শহরে আক্রমণ শুরু করার বিষয়ে গত সোমবার আবারও জরুরিভাবে সতর্ক করেছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন। এর আগেও বারবার রাফাহ শহরে হামলা না চালাতে ইসরায়েলকে সতর্ক করেছে যুক্তরাষ্ট্র। কিন্তু মার্কিন সতর্কবাণী রীতিমতো অগ্রাহ্যই করছেন নেতানিয়াহু। ফলে ফিলিস্তিনে মৃত্যুর সংখ্যা যত বাড়ছে, দুই দেশ আর দুই নেতার মধ্যে বিভাজনও ততটাই স্পষ্ট হয়ে উঠছে!
যুক্তরাষ্ট্রের আহ্বান, এমনকি সতর্কবাণীও বারবার উপেক্ষা করার স্পর্ধা কীভাবে দেখাচ্ছেন নেতানিয়াহু? বিশ্লেষকরা বলছেন, ইসরায়েলের প্রতি বাইডেন প্রশাসনের নিরবচ্ছিন্ন সমর্থনই কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।
তবে এ কথাও ঠিক, বাইডেন নেতানিয়াহুকে ফোন করে হুঁশিয়ার করেছিলেন। বলেছিলেন, রাফায় হামলা চালানো হলে ইসরায়েলকে দেওয়া অস্ত্রের চালান বন্ধ করে দেবে যুক্তরাষ্ট্র। হয়েছেও তাই। এই ফোন কলের দুই দিন পরই ইসরায়েলে পাঠানোর জন্য প্রস্তুত করা ২০০০ ও ৫০০ পাউন্ড ওজনের বোমার চালান বন্ধ করে দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র।
শুধু তাই নয়, ইসরায়েলকে আরও অস্ত্র সহায়তা পাঠানো বন্ধ করে দেওয়ার কথাও জানিয়েছেন মার্কিন প্রতিরক্ষামন্ত্রী লয়েড অস্টিন। কিন্তু সত্যিই কি তাই?
ডিসেম্বরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নেতানিয়াহুকে সতর্ক করে বলেছিলেন, গাজায় ইসরায়েলের নির্বিচার হামলা, তাদের বন্ধুত্বে ফাটল ধরাতে পারে। এমনকি মিত্র দেশটিতে সমর্থন দেওয়ার বিষয়টি তার দেশকে ঝুঁকির মধ্যে ফেলবে বলেও জানিয়েছেন বাইডেন।
সতর্ক করলেও, সেবার ইসরায়েলকে অস্ত্র পাঠিয়েছিল ইসরায়েল। বাইডেনের নিজের রাজ্য দেলাওয়ার থেকে অস্ত্র নিয়ে দক্ষিণ ইসরায়েলে যায় একটি কার্গো বিমান।
মার্কিন প্রশাসনের কর্মকর্তারা বলেছেন, ইসরায়েল উল্লেখযোগ্য পরিমাণে অস্ত্র পাচ্ছে এবং যা কিছুই হোক না কেন, এর পরিবর্তন হবে না।
বিষয়টি এমন যে, যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে গাজায় হামলা না চালানোর অনুরোধ করছে। সতর্ক করছে। হুঁশিয়ারি দিচ্ছে।
একই সঙ্গে গাজায় ত্রাণ সাহায্য পাঠাচ্ছে। কখনও ত্রাণের জন্য বন্দর বানাচ্ছে। কখনও আকাশ থেকে প্যারাসুটের মাধ্যমে ত্রাণ ফেলছে। দেখে মনে হচ্ছে, তারা কত কিছুই না করছে গাজার জন্য। ফিলিস্তিনিদের জন্য।
কিন্তু আবার যুক্তরাষ্ট্র বারবার ইসরায়েলে অস্ত্রও পাঠাচ্ছে। এইসব অস্ত্রই তো ইসরায়েলি সেনারা গাজার ফিলিস্তিনিদের ওপর প্রয়োগ করছে। অস্ত্র হাতে না পেলে ইসরায়েল কি দিয়ে রাফাহ শহরে হামলা চালাতো? অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে, যখনই ইসরায়েলের অস্ত্র কম পড়ে, তখনই তারা তা জানায় যুক্তরাষ্ট্রকে। আরও অস্ত্র পাঠাতে অনুরোধ করে। আর তখন তখনই অস্ত্র নিয়ে ইসরায়েলে হাজির হয় যুক্তরাষ্ট্র!
বাইডেন প্রশাসনের এক সিনিয়র কর্মকর্তা বলেছেন, আমি এমন কোনও দৃশ্য কল্পনা করতে পারি না যেখানে ইসরায়েলের আত্মরক্ষার জন্য যে কোন ধরনের প্রয়োজন আটকে রাখবে হোয়াইট হাউস। এমনকি সেটা যদি শেষ পর্যন্ত রাফাহ শহরে হামলাও হয়, তারপরও না।
অবশ্য ইসরায়েলে এই অস্ত্র পাঠানো নিয়েই দেশের ভেতরে ও বাইরে চাপের মুখে আছে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে এখনও বিক্ষোভ চালিয়ে যাচ্ছে ফিলিস্তিনপন্থি শিক্ষার্থীরা। মিশিগান, নর্থইস্টার্ন, ইন্ডিয়ানাসহ ইউনিভার্সিটি অব ইলিনয় শিকাগোতে স্নাতক অনুষ্ঠানে গাউন আর টুপি পরিহিত শিক্ষার্থীরা ফিলিস্তিনিদের প্রতি সংহতি জানাতে, তাদের স্বাধীনতার প্রতীক কেফিয়াহ বা বিশেষ স্কার্ফ গলায় বেধে সার্টিফিকেট নিতে মঞ্চে উঠেছে। আর কলাম্বিয়া, ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া ও ক্যালিফোর্নিয়া স্টেট পলিটেকনিক বিশ্ববিদ্যালয় স্নাতক অনুষ্ঠান বাতিল করেছে।
এদিকে, ব্রুকিংস ইনস্টিটিউশনের সিনিয়র ফেলো ও চার মার্কিন প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টা ব্রুস রিডেল বলেছেন, মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে উত্তেজনা বাড়ার সঙ্গে, ইসরায়েলকে সমর্থনের জন্য যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে কূটনৈতিকভাবে বিচ্ছিন্ন হওয়ার ঝুঁকিও পাল্লা দিয়ে বাড়ছে।
গাজায় ইসরায়েলি হামলায় এরই মধ্যে ৩৪ হাজার ৯৭১ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছে। আহত হয়েছে কমপক্ষে ৭৮ হাজার ৬৪১ জন। এর উপর আবার রাফাহ শহরে অভিযান চালানোর ঘোষণা দিয়েছেন নেতানিয়াহু। আর এই রাফাহ শহরে আশ্রয় নিয়েছে অন্তত ১০ লাখ শরণার্থী। নেতানিয়াহুর ঘোষণার পর থেকেই সরব হয়ে উঠেছে পশ্চিমা বিশ্বসহ আরব দেশগুলোও। কাতার আর মিসরের মধ্যস্থতায় হামাস আর ইসরায়েলের মধ্যে একটি কার্যকর যুদ্ধবিরতির জন্য বারবার আলোচনা চালিয়ে যাচ্ছিল। তবে সেই আলোচনায় যুক্তরাষ্ট্র মূলত হামাসের হাতে জিম্মি হওয়া ইসরায়েলিদের মুক্তির বিষয়টিতেই জোর দিয়েছে বেশি। সবশেষ আলোচনায় প্রতিনিধিদের সাথে এমনকি সিআইএ প্রধানও অংশ নিয়েছিল। কিন্তু সেই আলোচনাও ভেস্তে গেলে, সত্যিকার অর্থেই ঝামেলায় পড়ে যায় বাইডেন প্রশাসন।
মিটভিমের প্রেসিডেন্ট ও প্রতিষ্ঠাতা এবং ডিপ্লোমেডের সহ-প্রতিষ্ঠাতা নিমরোদ গোরেন বলেছেন, ইসরায়েলের প্রতি আমেরিকান সমর্থন শক্তিশালী। রাফাহ শহরে হামলা নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের সর্বশেষ হতাশা মূলত নেতানিয়াহুকে কেন্দ্র করে। কারণ একাধিক বিষয়ে নেতানিয়াহুর আচরণে হতাশ মার্কিন প্রশাসন। এর মধ্যে অন্যতম একটি কারণ হলো মানবিক ইস্যু।
জাতিসংঘসহ বিভিন্ন মানবাধিকার সংস্থাগুলো, গাজায় দুর্ভিক্ষ আসন্ন বলে বারবার সতর্ক করে আসছে। শুধু খাবারের অভাব নয়, সেখানে চিকিৎসা সরঞ্জামের অভাব। চিকিৎসকের অভাব। ঘরবাড়ি তো নেই। লোকজন রাস্তায় খোলা আকাশের নিচে জীবন যাপন করছে। আরব সেন্ট ওয়াশিংটন ডিসি নামের মানবাধিকার সংস্থার গবেষণা ও বিশ্লেষণ বিভাগের পরিচালক ইমাদ হারব বলেন, যার মধ্যে ন্যূনতম বিবেক রয়েছে, তিনিই গাজায় ইসরায়েলি কর্মকাণ্ড নিয়ে ক্ষুব্ধ হবেন।
এমন পরিস্থিতিতে নেতানিয়াহুকে যুক্তরাষ্ট্র চাপের মুখে রাখবে, সেটাই স্বাভাবিক। আর সেটাই হয়েছে। ইসরায়েলে অস্ত্র চালান বন্ধ করেছে যুক্তরাষ্ট্র। যদিও চালানটি ছোট, তারপরও এ থেকেই হয়ত ইসরায়েলের কাছে ইঙ্গিতটা স্পষ্ট হবে বলে ধারণা করছেন বিশ্লেষকরা।
নিউ ইয়র্ক টাইমসের কলামিস্ট থমাস এল ফ্রিডম্যান লিখেছেন, অস্ত্র চালান বন্ধের এই পদক্ষেপ নেতানিয়াহুকে একটাই ইঙ্গিত দিয়েছে; আর তা হলো- আজ ইসরায়েলকে হুমকি দেওয়া সবচেয়ে বিপজ্জনক নেতা জো বাইডেন নয় বরং বেনিয়ামিন বিবি নেতানিয়াহু!
তিনি আরও বলেছেন, নেতানিয়াহুর নেওয়া নীতিগুলো গাজায় টেকসই বিজয় আনতে পারেনি; পারবেও না। ইসরায়েলকে তার অস্তিত্বের সবচেয়ে বড় হুমকি ইরানের বিরুদ্ধেও সুরক্ষিত করতে পারছে না। বরং বিশ্বে ইহুদিদের বিপন্ন করে তুলছে এবং যুক্তরাষ্ট্রের বৃহত্তর মধ্যপ্রাচ্যের কৌশলগত ও লক্ষ্যগুলোকে ক্ষুণ্ন করেছে। আর এ কারণেই ইসরায়েলের সাথে যুক্তরাষ্ট্রের বিভাজন বাড়ছে। ব্যবধান বাড়ছে নেতানিয়াহু ও বাইডেনের মধ্যে।
কিন্তু আসলে যুক্তরাষ্ট্রের কোনও পদক্ষেপই কার্যকর হবে না, যদি না গাজায় ইসরায়েলি হামলা বন্ধ হয়। আর তার জন্য ইসরায়েলকে সব ধরনের অস্ত্র সহায়তা বন্ধ করে দিতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু সেটা কি করতে পারবেন জায়নবাদী জো বাইডেন? সেটা দেখতে হলে, হয়ত আরও প্রাণ ঝরবে গাজায়।

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *