সংবাদ শিরোনাম:

আইলার ১৫ বছর, উপকূলের নতুন আতঙ্ক ‘রিমাল’

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

খুলনা প্রতিনিধি:

ঘূর্ণিঝড় আর জলোচ্ছ্বাসের খবর শুনলেই আঁতকে ওঠেন উপকূলীয় উপজেলা কয়রা, শ্যামনগরের বাসিন্দারা। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসে নদীর পানি বেড়ে এই বুঝি বাঁধ ভেঙে ভেসে যাবে সবকিছু। এর আগে উপকূলে যতবার ঝড় আঘাত হেনেছে ততবারই ভেসে গেছে তাদের ঘরবাড়ি। সেসময় যথাযথভাবে বাঁধ মেরামত না হওয়ায় ঝুঁকিতে রয়েছেন উপকূলের তিন লক্ষাধিক মানুষ।
উপকূলবাসীর কাছে আতঙ্কের মাস মে। প্রতিবছর এই মাসের শেষে সুন্দরবন উপকূলে আছড়ে পড়ে বিভিন্ন প্রলয়ংকরী সব ঘূর্ণিঝড়। স্মরণকালের সবচেয়ে বড় জলোচ্ছ্বাস আইলাও আঘাত হেনেছিল এই মে মাসের ২৫ তারিখ। তারপর ১৫ বছর পার হলেও এখনো নির্মাণ হয়নি স্থায়ী বেড়িবাঁধ। আগামী ২৬ তারিখে আঘাত হানতে পারে ঘূর্ণিঝড় ‘রিমাল’, এমন বার্তায় চরম আতঙ্কের মধ্যে দিন পার করছেন নদী তীরবর্তী মানুষ।
এলাকাবাসী, জনপ্রতিনিধি ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের কর্মকর্তাদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কয়রা সদর ইউনিয়নের মদিনাবাদ লঞ্চঘাট থেকে গোবরা পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার, হরিণখোলা-ঘাটাখালী এলাকায় এক কিলোমিটার, ৫ নম্বর কয়রা ক্লোজার, স্লুইস গেট সংলগ্ন ৫০০ মিটার, ৬ নম্বর কয়রা এলাকায় ৬০০ মিটার, ২ নম্বর কয়রা এলাকায় ৫০০ মিটার, মহারাজপুর ইউনিয়নের মঠবাড়ি-দশহালিয়া এলাকায় দুই কিলোমিটার, উত্তর বেদকাশি ইউনিয়নের কাঠকাটা থেকে শাকবাড়িয়া গ্রাম পর্যন্ত এক কিলোমিটার, কাশির হাটখোলা থেকে কাটমারচর পর্যন্ত ৭০০ মিটার, গণেষ মেম্বারের বাড়ির পাশে, পাথরখালী এলাকায় ৬০০ মিটার ও মহেশ্বরীপুর ইউনিয়নের শেখেরকোনা, নয়ানি, শাপলা স্কুল, তেঁতুলতলার চর ও চৌকুনি এলাকায় তিন কিলোমিটারের মতো বাঁধ ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, মদিনাবাদ লঞ্চঘাট এলাকায় ১ কিলোমিটার বাঁধ ধসে সরু হয়ে গেছে। চর ভেঙে একেবারে বাঁধের পাশ দিয়ে স্রোত প্রবাহিত হচ্ছে। কয়েক জায়গায় নিচু বাঁধের ওপর মাটির দেওয়াল তৈরি করে জোয়ারের পানি ঠেকানোর চেষ্টা করা হয়েছে।
মঠবাড়ী গ্রামের আবু সাইদ মোল্যা বলেন, ‘শাকবাড়িয়া নদীর পানির চাপে কাশিয়াবাদ ফরেস্ট স্টেশন সংলগ্ন সুতি বাজার স্লুইসগেটের দুই পাশে বাঁধে ফাটল ধরিচে। তবুও পানি উন্নয়ন বোর্ড তা মেরামত করছে না। সময়ের কাজ সময় মতো করলে আমাদের এত ভোগান্তি হতো না। গাঙের পানি যখন চরের নিচে থাকে, তখন কারো দেখা পাওয়া যায় না। যেই সময় গাঙের পানি বাঁধের কানায় কানায় এসে ঠেকে, তখনই শুরু হয় বড় সাহেবগো তোড়জোড়। এ পর্যন্ত যতবার ওয়াপদা ভাঙিছে সব ওই সাহেবগের গাফিলাতির কারণেই ঘটিছে।’
গাববুনিয়া গ্রামের ষাটোর্ধ্ব উশিলা মন্ডল বলেন, ‘ঝড়-বন্যায় বাঁধ ভাঙ্গি ঘরবাড়ি সব গাঙে গেছে। বার বার এভাবে ভাঙলি আমাগি আর বসবাসের জায়গা থাকবে না। শুনতিছি আবার একটা ঝড় আসবে, ভেঁড়ির যে অবস্থা তাতে কখন ভাঙি পানি ঢোকে সেই চিন্তায় আছি।’
কয়রা সদর ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান এসএম লুৎফার রহমান বলেন, এ পর্যন্ত যতগুলো দুর্যোগ এসেছে, তার বেশিরভাগ মে মাসে। এজন্য মে মাস এলে আতঙ্কিত থাকে উপকূলীয় কয়রার শত শত মানুষ। প্রতি বছর মে মাস এলেই পাউবো কর্তৃপক্ষ বাঁধ মেরামতে খুব তোড়জোড় শুরু করে। কী কারণে সেটা কেউ বলতে পারে না। অথচ শীত মৌসুমে কাজ করার অনেক সুবিধা।
তিনি অভিযোগ করেন, বরাদ্দের টাকা আত্মসাতের সুযোগ সৃষ্টির জন্য পাউবোর লোকজন অসময়ে এসে কাজ ধরেন।
পানি উন্নয়ন বোর্ড খুলনার নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আশরাফুল আলম বলেন, কয়রার ঝুঁকিপূর্ণ বাঁধের তালিকা করা হয়েছে। কিছু এলাকায় সংস্কারকাজ এরই মধ্যে শুরু হয়েছে। বর্তমানে কয়রার উত্তর বেদকাশী ও দক্ষিণ বেদকাশী ইউনিয়নে বাঁধ নির্মাণসহ প্রায় ১ হাজার ২০০ কোটি টাকার মেগা প্রকল্পের কাজ চলমান রয়েছে। প্রকল্প শেষ হলে ৩১ কিলোমিটার বাঁধ ঝুঁকিমুক্ত হবে। পর্যায়ক্রমে ঝুঁকিপূর্ণ অন্যান্য বাঁধগুলোর জরুরি ভিত্তিতে কাজ করা হবে। তবে বড় প্রাকৃতিক দুর্যোগ না এলে কোনো সমস্যা হবে না।
সিডরের দুই বছরের মধ্যে উত্তর ভারত মহাসাগরে জন্ম নেয় ঘূর্ণিঝড় আইলা। ২০০৯ সালের ২১ মে ভারতের কলকাতা থেকে ৯৫০ কিলোমিটার দক্ষিণে ওই ঝড়ের সৃষ্টি হয়। ঘূর্ণিঝড়টি ২৫ মে বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাংশে ও ভারতের দক্ষিণ-পূর্বাংশে আঘাত হানে। টানা ১৫ ঘণ্টার ঝড় ও ১২ ফুট উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে গোটা উপকূলীয় এলাকা লন্ডভন্ড হয়ে যায়।
শ্যামনগরের উপকূল জনপদের বিভিন্ন এলাকায় দুর্বল বেড়িবাঁধ ভেঙে এলাকার পর এলাকা লবণ পানিতে তলিয়ে যায়। এই ঝড়ে বহু কাঁচা-পাকা ঘরবাড়ি, ফসলের ক্ষেত ও মাছের ঘের ভেসে গিয়ে কোটি কোটি টাকার ক্ষতি হয়। নিহত হন শিশুসহ ৭৩ জন নারী-পুরুষ। এরমধ্যে ৫৩ জন মারা যান সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলার গাবুরা ইউনিয়নে। বাকি ২০ জন পার্শ্ববর্তী পদ্মপুকুর ইউনিয়নের বাসিন্দা। হাজার হাজার গবাদি পশুর মৃত্যু হয়। উপকূলজুড়ে দেখা দেয় অর্থনীতি সংকট।
সরেজমিনে জানা গেছে, আইলার সেই ক্ষত এখনো কাটিয়ে উঠতে পারেনি উপকূলবাসী। এরপর ২০১৯ সালের ৪ মে ফণী, ওই বছরের ১০ নভেম্বর বুলবুল, ২০২০ সালের ২০ মে আম্ফান, ২০২১ সালে ২৬ মে ইয়াস, ২০২২ সালের ১২ মে আসনি এবং সর্বশেষ গত ১৪ মে মোখা আঘাত হানে।

Facebook
LinkedIn
WhatsApp
Email
Print

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *